পুজোর বনেদিয়ানা

কবিগুরু লিখে গেছিলেন- 

    বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
     বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
                 দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা
                      দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
     দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
     ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
                    একটি ধানের শীষের উপরে
                      একটি শিশিরবিন্দু।

হ্যাঁ সেই শিশিরবিন্দুর খোঁজেই এইবার পুজোর সময় বেরিয়ে পরেছিলাম আমরা, আমরা মানে আমি আর সোহিনী। দুর্গা পুজা নিয়ে বাঙালীর অনেক ফ্যান্টাসি, অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। তবে বর্তমানে বাঙালীর পুজো মূলত কলকাতার নানা দিকে ছড়িয়ে থাকা থিমের পুজো। কিন্তু পুজোর বনেদিয়ানার স্বাদ পেতে বেরিয়ে পড়লাম আমরা।
                          
                       শুরু করলাম জানবাজারের রানী রাসমণি প্রচলিত দুর্গাপুজো দর্শন কোরে। তৎকালীন জানবাজার আজ আমাদের অতি পরিচিত এসপ্ল্যানেড অঞ্চল।রানীর সময়কার জৌলুস আজ আর নেই, রানীর বর্তমান বংশধরদের পুজো আজ ২ টি ভাগে বিভক্ত, পার্শ্ববর্তী অপর দুটি ভবনে এই পুজো দুটি হয়। তাও আজও রানীর প্রচলিত আদি পুজোটি টিকে আছে স্বমহিমায়ে। রানীর পুজো দর্শন কোরে আমরা এগিয়ে  চললাম ঠনঠনিয়া দত্ত বাড়ির দিকে। এসপ্ল্যানেড থেকে বাস ধরে সেন্ট্রাল অ্যাভেন্যু তে নামলাম সেখান থেকে ভেতর রাস্তা ধরে হাটা। রাস্তা বলতে সরু অলিগলি আর তার দুই ধারে দীর্ণ জীর্ণ পুরনো বাড়ির সারি।এটা কলকাতা কে এক নতুন ভাবে চেনা।


রানী রাসমণি প্রচলিত আদি পুজো
রানী রাসমণির কাছারি বাড়ি
                         
                        ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির বিপরীতেই অবস্থিত এই দত্ত বাড়ি। ১৮৫৫ সালে দ্বারকানাথ দত্ত এই পুজো প্রচলন করেন। এইখানে দুর্গা প্রতিমা একটু ভিন্নরূপ, মহিষাসুরমর্দিনীর বদলে এখনে হরগৌরির পুজো করা হয়। খানিকক্ষণ এখানে কাটিয়ে আমরা বেড়িয়ে পরলাম পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ির উদ্দেস্যে। 

ঠনঠনিয়া দত্ত বাড়ির হরগৌরি বিগ্রহ
                         
                         সি. আর. এভিনিউ থেকে শোভাবাজারগামী মিনিবাস ধরে গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশন নামলাম সেখান থেকে ১০ মিনিটের হাটা পথ, পথে পড়লো বিখ্যাত ভীমনাগের মিষ্টির দোকান সেখানে কিছু জলযোগ সেরে আমরা আবার পারি দিলাম আমদের গন্তব্যে। পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়িতে যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যারতি ছলছে আমরাও সামিল হলাম তাতে। ঢাক কাসর ঘণ্টার শব্দ আর ধুপ ধুনার গন্ধে এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।প্রায় ১৬৭ বছর আগে বাবু খেলাৎ ঘোষ এই পুজোর প্রচলন করেন। আজও মহাসমারহে এই পুজো হয়ে আসছে। বাবু খেলাৎ ঘোষ নিজে অসাধারন ধ্রুপদ সঙ্গিত শিল্পী ও সঙ্গিতানুরাগী ছিলেন, তৎকালীন অনেক গুণী শিল্পী ওনার সমাদর পেয়েছেন। আজও তাঁর সেই কাজ কে অমর করে রেখেছেন ওনার পরিবারের বর্তমান সদস্যগণ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পদধুলি ধন্য এই বাড়িতেই All Bengal Music Conference এর, আসর বসে, ১৯৩৪ সালে যা শুরু করেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 
                      
পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ীর দুর্গা প্রতিমা
পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ীর ঠাকুর দালান

                          পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ীর পর এইবার আমাদের যেতে হবে ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়ি, অর্থাৎ রামদুলাল নিবাস। বিডন স্ট্রিট আর সি.আর.অ্যাভেন্যুর সংযোগস্থলে অবস্থিত এই বাড়িতে ১৭৭০ সালে দূর্গাপুজো শুরু করেন রামদুলাল দেব (সরকার)। এই রামদুলাল দেবই হলেন বাংলার প্রথম কোটিপতি। মার্কিনীদের সাথে উনিই প্রথম বানিজ্য শুরু করেন এবং প্রভূত সম্পত্তির মালিক হন।অতি দরিদ্র পরিবার থেকে নিজের যোগ্যতায়ে শুধু অর্থই নয়ে মার্কিনীদের থেকে প্রভূত সম্মানও অর্জন করেছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার হন ওনার দুই পুত্র আশুতোষ নাথ দেব এবং প্রমথনাথ দেব (ছাতুবাবু ও লাটুবাবু)। প্রায়ে ২৪৩ বছরের পুরনো এই পুজো আজও মহাসমারোহে পালিত হয়ে আসছে। পরিবারের বর্তমান সদস্য দের উদ্দিপনা চোখে পরার মত।

ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়ির পুজো
ছাতুবাবু লাটুবাবুর ঠাকুর দালান

                     এইবার আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য সকলের অতি পরিচিত শোভাবাজার রাজবাড়ী। রামদুলাল নিবাস থেকে বেরিয়ে সি.আর.অ্যাভেন্যু ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম শোভাবাজার রাজবাড়ী। ১৭৫৭ সালে রাজা নবকৃষ্ণদেব এই পুজোর প্রচলন করেন।স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ এই পুজোতে অতিথি হয়ে আসতেন। একসময় মহাসমারোহে এবং বহু অর্থব্যয়ে এই পুজো হত। আজ সময়ের সাথে সাথে সেই জৌলুসে কিছুটা ভাটা পড়লেও ঐতিহ্য আর উৎসাহে কোন ভাটা পড়েনি। দুর্গা প্রতিমা দর্শনের পাশাপাশি আমরা রাজ পরিবারের কুলদেবতা গোপিনাথ জিঁউ কেও দর্শন করলাম। ঠাকুর দালানের ডানপাশের একটি সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে কুলদেবতার ঘরে যেতে হয়। শোভাবাজার রাজবাড়ী কলকাতার নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, শিকাগো ধর্ম মহাসভা থেকে দেশে ফেরার পর কলকাতায়ে এই বাড়িতেই স্বামী বিবেকানন্দ কে প্রথম নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। শোভাবাজার আদি রাজবাড়ীটির ঠিক বিপরীত দিকেই এই রাজবাড়ীর বংশধরদের অপর একটি বাড়ি আছে, এখানেও মহাসমারোহে পুজো হয়ে।

শোভাবাজার রাজবাড়ী
শোভাবাজার রাজবাড়ীর প্রতিমা
শোভাবাজার রাজবাড়ীর (ছোট তরফ) প্রতিমা

                      অবশেষে ফেরার পালা, ঘড়ি বলছে রাত তখন ১১.৩০, রাজবাড়ী থেকে বেড়িয়ে একটা রেস্তুরাতে 
রাতের খাওয়া সেরে নিলাম। রাস্তা তখন জনারণ্য, দলে দলে মানুষ চলেছে কেউ ঠাকুর দেখতে, কেউ নিজের আপনজনের সাথে একটু সময় কাটাতে, আবার কেউ চলেছে পুজোর ছুটিটা চেটেপুটে উপভোগ করতে। আমরা মেট্রো তে উঠে গেলাম, অটোমেটিক দরজা ধিরে ধিরে বন্ধ হয়ে গেল, মেট্রো চলছে দুর্বার বেগে, পেছনে ধিরে ধিরে ঝাপসা হয়ে আসছে ইতিহাস। মেট্রোর গতিবেগ কি তাহলে ইতিহাস কে হারিয়ে দিল!! নাকি আমরাও একদিন চলে যাব ইতিহাসের গর্ভে?? কে জানে হয়তো উত্তর লেখা আছে ভবিষ্যতে।  



         

            
  








         

            
  







Comments

Popular Posts