পুরুলিয়া ভ্রমণ

বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা, অফিসে বসে কাজ করছি, পরের দিন থেকে দোল আর গুড ফ্রাইডে মিলিয়ে প্রায় ৫ দিনের ছুটি, তাই চরম ব্যস্ততার মুহূর্ত। এই সময় হঠাৎ সৌম্যর ফোন। ফোনটা  ধরার পর সৌম্য কোনো ভণিতা না করেই বলল রাতের ট্রেনে  পুরুলিয়া যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে তাই আমি যেন একটু আগে আগে অফিস থেকে বেরিয়ে যাই। আমি একটু ফাঁপরে পড়লাম কারণ আগে থেকে কিছুই ঠিক করা নেই আর তাছাড়া এক বছর আগেই পুরুলিয়া ঘুরে এসেছি। যাই হোক সব কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেল।  তড়িঘড়ি অফিস থেকে বেড়িয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। বাড়ি যখন পৌঁছালাম তখন আটটা বেজে গেছে। কোনোমতে ব্যাগ গুছিয়ে ডিনার সেরে বেরিয়ে পড়লাম স্টেশনের  উদ্দেশ্যে।
পথেই সৌম্য, অরুক ও অঙ্কনের সাথে দেখা করে ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম।আমাদের অপর দুই সঙ্গী অর্থাৎ সৌম্যর দুই অফিস কলিগ সোমনাথ দা আর কৃষ্ণেন্দু দা আমাদের আগেই হাওড়া পৌছে টিকিট কেটে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। খড়গপুর যাওয়ার ছয়টা  জেনারেল টিকিট কাটা হয়েছে। সবকটা  ট্রেনে গাদাগাদি  ভীড়। শেষমেশ পোরবন্দর এক্সপ্রেসের  জেনারেল কম্পার্টমেন্টে  বসার সিট পাওয়া গেল। রাত ১০.৫০ নাগাদ ট্রেন ছাড়ল। খড়গপুর যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে  তখন রাত ১২.৩৫ বাজে। এইখান থেকে ভোর ৪.৪০ নাগাদ পুরুলিয়া যাওয়ার ট্রেন ধরতে হবে। তাই এখানেই রেলের  রিটায়রিং রুম বুক করে বাকি রাতটুকু  কাটানোর ব্যবস্থা হলো।
একদিন দল বেধে কজনে মিলে
একদিন দল বেধে কজনে মিলে... 
ভোর ৪.২০ নাগাদ আমরা ট্রেনে উঠলাম, পুরী - দিল্লী পুরুষোত্তম এক্সপ্রেস। TTE কে অনুরোধ করে বাকি সময়টুকু ঘুমোনোর জন্য কয়েকটা বার্থের ব্যবস্থা করা হলো। সকাল ৮.৩০ নাগাদ পুরুলিয়া স্টেশনে নামলাম। স্টেশনে  আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন গণেশদা। গণেশদা PPSP বা পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ প্রজেক্ট  এর  ট্রান্সপোর্টের দায়িত্বে রয়েছেন। এখানে একটু বলা প্রয়োজন সৌম্য  West Bengal State Electricity Distribution Company Limited  এর একজন কর্মী এবং ওর উদ্যোগে এবং সোমনাথ দার সাহায্যে এত অল্প সময় এই প্ল্যানটা হয়েছে।যাই হোক, গাড়িতে উঠে আমরা প্রথমে একটা ধাবাতে গিয়ে পৌঁছালাম। সেখানে সকালের খাওয়া সেরে প্রথমে গেলাম পাখি পাহাড়। পলাশ, শাল, শিমুল গাছে ঘেরা পাখি পাহাড়ের মূল আকর্ষণ এর সারা গা জুড়ে ছোট বড় পাখির ছবি। শান্ত সবুজ পরিবেশে কিছুক্ষন কাটিয়ে আমরা রওনা দিলাম বাঘমুন্ডিতে। বাঘমুন্ডির PPSP কোয়ার্টারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে পৌছে স্নান এবং দুপুরের খাওয়া সেরে বেলা তিনটে নাগাদ গাড়ি নিয়ে অযোধ্যা পাহাড় ঘুরতে বেরলাম। পাহাড়ের  উপরেই পর পর দেখলাম থুরগা ফলস, বামনি ফলস, আপার ড্যাম এবং লোয়ার  ড্যাম।   সব শেষে আমরা গিয়ে পৌছালাম PPSP প্রজেক্ট এর ভেতরে। জাপানী প্রযুক্তির সাহায্যে অযোধ্যা পাহাড়ের ভেতর সুরঙ্গ কেটে প্রায় ৭ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই জলবিদ্যুত কেন্দ্রটি  নির্মান করা হয়েছে। আপার ড্যাম ও লোয়ার ড্যাম কে কাজে লাগিয়ে কৃত্তিম ভাবে খরস্রোত তৈরী করে টারবাইন ঘুড়িয়ে প্রায় ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন  করা হয় এখানে । সৌম্য, কৃষ্ণেন্দু দা এবং সোমনাথ দা WBSEDCL এর কর্মী হওয়ার সুবাদে এর ভেতরে ঢোকার সৌভাগ্য হলো আমাদের। প্রযুক্তির এক অপূর্ব ক্ষমতার সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা। PPSP থেকে যখন বেরলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কাছেই দোল উৎসব উপলক্ষে ছৌ নাচের আসর বসেছিল, সেখানে গিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে রাত আটটা নাগাদ কোয়ার্টারে ফিরে এলাম।
 পাখি পাহাড়ের পথে
পাখি পাহাড়ের পথে
পাখি পাহাড়
পাখি পাহাড়
থুরগা ফলস
থুরগা ফলস
পরের দিন সকাল ৮.৩০ নাগাদ আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। পথেই পরোটা এবং জিলিপি সহযোগে জলখাবার সেরে নিলাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য খয়রাবেরা ড্যাম। বাঘমুন্ডি থেকে প্রায় ১৪ কিমি দুরে অবস্থিত খয়রাবেরা ড্যাম আসলে একটি সেচ বাঁধ। চারদিকে পাহাড় এবং সবুজ অরণ্যে ঘেরা এই জায়গাটির  অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে  চোখ জুড়িয়ে যায়। খয়রাবেরা ড্যামে কিছুক্ষন কাটিয়ে আমরা গেলাম ঝালদার কাছে WBSEDCL এর ওপর একটি নির্মীয়মান জলবিদ্যুত প্রকল্প দেখতে। গ্রামের ভেতর দিয়ে পথ। চারদিকে কোথাও মাটির বাড়ির সারি, কোথাও পুকুর, চাষের ক্ষেত, কোথাও বা পলাশের বন তার রক্তিম আভা দিয়ে বসন্তের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে । দূরে মাঝে মাঝে একটা নাম না জানা পাহাড়ের টিলা উঁকিঝুকি দিচ্ছে। এইভাবে পথ চলতে চলতে একসময় এসে পৌছালাম একটা কূলের বাগানে। বাগানের এইসব কূল গাছেই লাক্ষা কীটের  চাষ করা হয়।লাক্ষা চাষে ঝালদা একটি অন্যতম নাম। গণেশদা লাক্ষা চাষ সম্পর্কে অনেক খুটিনাটি আমাদের বোঝালেন।এরপর আবার আমদের পথ চলা শুরু হল।  আরো কিছুটা পথ যাওয়ার পর আমাদের গাড়ি একটা বনের ভেতর ঢুকলো। পাহাড়ী জঙ্গলের এবরোখেবড়ো পথে টালমাটাল ভাবে কিছুক্ষন চলার পর আমরা আমদের গন্তব্যে পৌঁছালাম।  চারদিকে পাহাড় এবং গভীর অরণ্যের মধ্যে ডিনামাইট ফাটিয়ে পাহাড়ে সুরঙ্গ কাটার কাজ হচ্ছে এখানে। হোলির ছুটি থাকার ফলে কাজ বন্ধ ছিল সেদিন। আমরা ওই অসম্পূর্ণ সুড়ঙ্গে  কিছুটা ঢুকে দেখলাম। ভেতরটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার এবং উগ্র সালফারের গন্ধে ভরপুর। কিছুটা এগোনোর পর তাই দম নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। সুড়ঙ্গ থেকে বেড়িয়ে গণেশদার কাছে শুনলাম যে, কোনো এক সময় এই পাহাড়ের উপর একটি গুহাতে নাকি নরবলি হত।  একজন তান্ত্রিক সন্ন্যাসী নাকি প্রতি অমবস্যার রাতে গ্রাম থেকে ছোট ছেলেদের ধরে এনে বলি দিতেন। একসময় একটি ছেলেকে দেখে তার মনে মায়া জন্মায়ে এবং তাকে মুক্তি দেন। পরে নিজের খাঁড়াটা ছুড়ে ফেলে দেন। খাঁড়াটা যেখানে এসে পড়েছিল সেখানে এখন বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে পূজার আয়োজন করা হয়। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে গণেশদা আমাদের সেই জায়গাটাও দেখালেন। এবার আমাদের কোয়ার্টারে ফেরার পালা তবে ফিরতি পথে আমরা যাব চড়িদা গ্রাম। ছৌ নাচ এবং ছৌ মুখোশ তৈরীর জন্য এই গ্রামটি বিখ্যাত। ভারতবর্ষের লোকশিল্প গুলির মধ্যে ছৌ নৃত্য একটি অন্যতম নাম। মোট তিন রকমের ছৌ ঘরানা রয়েছে আমাদের দেশে যাদের মধ্যে পুরুলিয়া ঘরানা অন্যতম। বাকি দুটি হলো সেরাইকেলা ঘরানা ও ময়ুরভঞ্জ ঘরানা। চড়িদা গ্রামে পৌঁছে আমরা পর পর কয়েকটা মুখোশের দোকান ঘুরে দেখলাম। প্রতিটা দোকানেই প্রায় তিন চার  জন কর্মী মুখোশ তৈরী করছেন। এই মুখোশের মূল উপকরণ মাটি, কাগজের মন্ড এবং কাপড়। প্রথমবার এসে আমরা সকলেই অনেক গুলো মুখোশ কিনে নিয়ে গেছিলাম।  এইবার কৃষ্ণেন্দু দা আর সোমনাথ দা দুটো মুখোশ কিনল। চড়িদা গ্রামে কিছুক্ষন থাকার পর আমরা কোয়ার্টারে ফেরার পথ ধরলাম।
কোয়ার্টারে ফিরে স্নান খাওয়া সেরে সকলেই একটু ঘুমিয়ে নিলাম। কথা ছিল সন্ধ্যা বেলা ঝুমুর নাচ দেখতে যাওয়ার। কিন্তু সেটা আর এই যাত্রা দেখা হলো না। সন্ধ্যা বেলা  আমরা গ্রামের পথে একটু হাটতে বেরোলাম। কিছুটা হাটার পর একটা খোলা জায়গাতে বসে আড্ডা চললো অনেকক্ষণ। রাত ৯.৩০ নাগাদ ফিরে আসলাম। পরেরদিন ভোর  ৫.৩০ নাগাদ ফেরার ট্রেন, পুরুলিয়া এক্সপ্রেস। গণেশদা গাড়ী নিয়ে চারটে নাগাদ চলে আসবে আমাদের নিতে। এবারের মত বিদায় পুরুলিয়া !  

সবুজের সন্ধানে অযোধ্যা পাহাড়ে
সবুজের সন্ধানে অযোধ্যা পাহাড়ে

আপার ড্যাম
আপার ড্যাম

দিন তো গেল, সন্ধ্যা হলো...
দিন তো গেল, সন্ধ্যা হলো...
লোয়ার ড্যাম
লোয়ার ড্যাম
আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...
আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...
ছৌ নাচের আসরে
ছৌ নাচের আসরে
ছৌ নাচের আসরে
ছৌ নাচের আসরে
ছৌ নাচের আসরে
ছৌ নাচের আসরে
খয়রাবেরা ড্যাম
খয়রাবেরা ড্যাম
খয়রাবেরা ড্যাম
খয়রাবেরা ড্যাম
নির্মীয়মান জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
নির্মীয়মান জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
অসম্পূর্ণ টানেল
অসম্পূর্ণ টানেল
চড়িদা গ্রামে
চড়িদা গ্রামে
শুভ অশুভর দ্বন্ধ
শুভ অশুভর দ্বন্ধ 
কিরাত কিরাতি
কিরাত কিরাতি

      

Comments

Popular Posts