চড়ক দর্শন

হর গৌরি প্রাণনাথ,
দাতা রূপে জগন্নাথ
এইবার উদ্ধার কর
শিব শিব শিব হে।

প্রলয়ের দেবতা মহাদেব।এই মহাদেবের সন্ধান প্রথম পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতার ধংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত একটি সিল থেকে। পরবর্তীকালে বহু পুরাণ, মঙ্গলকাব্য ও অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থে শিব অথবা মহাদেবের উল্লেখ পাওয়া যায়।তিনি দেবাদিদেব অর্থাৎ সকল দেবতার আরাধ্য তিনি। কৈলাশ পর্বতে তার অধিষ্ঠান। তিনি ত্রিশুলধারী, ব্যঘ্রচর্ম পরীহিত মহাযোগী।কিন্তু বাঙালি সমাজের কাছে তিনি যেন অপনজন নানা রূপে এবং নানা ভাবে তিনি বাঙালি গৃহে বিরাজমান। ছোটো ছোটো মেয়েরা ভাবে শিবের মত বর চাই, বিবাহযোগ্যা কন্যার মায়েরা ভাবে জামাই যেন হয় শিবের মত আবার সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছেলেদের উৎসাহ শিবের বোহেমিয়ান চালচলন এবং বেশভূষাতে। সাধক কুলের কাছেও তিনি সমাদৃত কারণ তিনি নিজেই ত্যাগ এবং সাধনার প্রতিমূর্তি অপর দিকে তিনি অল্পেতেই সন্তুষ্ট, সামান্য জল বেলপাতা দিয়েই তার সাধনাতে সিদ্ধিলাভ করা যায়।তবে কৃচ্ছ সাধন মার্গও আছে, যেমন চড়ক কিংবা গাজন। চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন হয় এই চড়ক উৎসব। যদিও এর প্রস্তুতি চলে প্রায় পনেরো দিন আগে থেকে। গ্রামের পুরুষরা দল গঠন করে পনেরো দিন ধরে সন্ন্যাস  ব্রত পালন করে। এই সময় তারা মাছ মাংস বর্জন করে শুধু মাত্র ভিক্ষালব্ধ চাল ও সব্জি দিয়ে বানানো হবিষ্যি গ্রহণ করে।

আমরা দুজন...
আমরা দুজন...
            এই চড়ক উৎসব সূচনার সময়কাল সেভাবে জানা যায় না কিন্তু এর উৎস কিন্তু মোটেই হিন্দু ধর্ম নয়। এই  উৎসব প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ উৎসবের রূপান্তরিত  রূপ। বাংলায় যখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ম্লান হয়ে আসছে তখন তাদের একটা অংশ হিন্দু ধর্মের সাথে মিশে যায় এর ফলে বৌদ্ধদের বহু তন্ত্রমন্ত্র, আচার এবং দেব দেবী হিন্দু ধর্মে ঢুকে পরে।শিবের গাজন বা চড়ক আসলে বৌদ্ধ দেবতা ধর্ম ঠাকুরের পূজা, অনেক ক্ষেত্রে একে ধর্ম ঠাকুরের গাজনও বলা হয়।পরবর্তীকালে এই ধর্ম ঠাকুর এবং শিব মিলে  মিশে এক হয়ে যায়। এই উৎসবের উদ্দেশ্য কৃষি দেবতা রূপি শিবের আবাহন। কৃচ্ছ সাধনের মাধ্যমে ভগবান শিবকে সন্তুষ্ট করে কৃষির সমৃদ্ধি এই উৎসবের লক্ষ্য।

ছেলেবেলায় স্কুলের পাঠ্যে, গল্পের বইয়ে এবং বড়দের মুখে বহুবার এই  চড়কের কথা ঘুরে ফিরে এসেছে।চৈত্র মাসে বাড়িতে বাড়িতে ঢাক বাজিয়ে লাল কাপড় পরিহিত চড়ক সন্ন্যাসিদের ভিক্ষা করতেও দেখেছি। কিন্তু এই উৎসবের প্রকৃত রূপ কখনো চাক্ষুস করা হয়ে ওঠেনি। তাই এই বছর চৈত্র সংক্রান্তির দিন আমি আর মনোজীৎ বেড়িয়ে পড়লাম চড়কের মেলা দেখতে। আমাদের গন্তব্য বর্ধমান জেলার বাঘনাপাড়া। অম্বিকা কালনার পরের স্টেশন এই বাঘনাপাড়া চড়ক উৎসবের  জন্য প্রসিদ্ধ। 

শুরুতে ঠিক হয়েছিল যে আগের দিন সন্ধ্যা বেলাতেই আমরা পৌছে যাব নির্দিষ্ট গন্তব্যে কারণ চড়কের আগের রাতে নানারকম আচার অনুষ্ঠান হয় যা কিছু কম আকর্ষনীয় নয়, কিন্তু আমাদের দুইজনেরই ব্যস্ততা থাকায়ে পরের দিন খুব ভোরে বেরোলাম। শিয়ালদহ থেকে কাটোয়াগামী যে কোনো ট্রেন বাঘানাপাড়াতে দাঁড়ায় কিন্তু আমরা যখন গিয়ে পৌছালাম তার কিছুক্ষণ আগেই একটা ট্রেন চলে গেছে এবং পরের ট্রেন প্রায় এক ঘন্টা পরে। তাই অপেক্ষা না করে আমরা ব্যান্ডেলগামী শিয়ালদা - মুজঃফরপুর প্যাসেঞ্জারে উঠে বসলাম। ঘন্টা দেড়েক পর ব্যান্ডেল পৌছে স্টেশনেই সকালের জলযোগ সেরে নিলাম। এরপর ব্যান্ডেল - কাটোয়া লোকাল চেপে বাঘনাপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বাঘনাপাড়া যখন পৌছালাম তখন প্রায় সকাল নটা বাজে। বাঘনাপাড়া স্টেশন থেকে গ্রামের ভেতরের পথ ধরে মিনিট দশেক হাটলেই কৃষ্ণদেবপুর হাই স্কুল, এই স্কুলের মাঠেই বসে চড়কের আসর।  আমরা যখন গিয়ে পৌঁছালাম তখনও কিছু শুরু হয়নি। আশপাশে কয়েকটা জিলিপি আর ঝুরি ভাজার অস্থায়ী দোকানে বিকিকিনি চলছে। আশেপাশে কয়েকজন লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে চড়কের পুজো শুরু হতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। ঘড়িতে দেখলাম সবে সাড়ে নয়টা বাজে অর্থাৎ আমাদের প্রায় পাঁচ ছয় ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। এতটা সময় কিভাবে কাটানো যায় সেই ভাবতে ভাবতে মাথায়ে এল যে কালনাতে রয়েছে ১০৮ শিব মন্দির। তাই ঠিক হলো যে এই ফাঁকে ওটা দেখে নেওয়া যাক।

কৃষ্ণদেবপুর হাই স্কুলের সামনে থেকে একটা অটো ধরে প্রথমে গেলাম কালনা বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে ওপর একটি অটো ধরে আমরা পৌছালাম ১০৮ শিব মন্দির। এই মন্দিরটির আশেপাশেই রয়েছে আরো কয়েকটি ছোটো বড় মন্দির। শুরুতেই দেখলাম জলেশ্বর মন্দির। পঞ্চরত্ন রীতিতে তৈরী এই ছোটো  মন্দিরটি সম্ভবত উনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছে। এই মন্দিরটির পাশেই ১০৮ শিব মন্দির। এই আটচালা মন্দিরগুলি ১৮০৯ সালে বর্ধমান রাজ তেজ চন্দ্র বাহাদুর  নির্মান করেন। মন্দির গুলি দুটি বৃত্তাকার সারিতে বিন্যস্ত।বাইরের সারিতে রয়েছে ৭৪টি মন্দির এবং ভেতরের সারিতে রয়েছে ৩৪টি মন্দির।এই মন্দিরগুলি সম্ভবত জপমালার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এই মন্দিরগুলির অপর একটি বৈশিষ্ট হল বাইরের মন্দির সারিতে ক্রমান্বয়ে সাজানো রয়েছে সাদা এবং কালো শিবলিঙ্গ কিন্তু ভেতরের সারিতে প্রত্যেকটি মন্দিরেই সাদা শিবলিঙ্গ রয়েছে। ১০৮ শিব মন্দিরের উল্টো দিকেই রয়েছে রাজবাড়ি কমপ্লেক্স।এই কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু মন্দিরের সমষ্টি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রতাপেশ্বর মন্দির, লালজি মন্দির, রাসমঞ্চ এবং কৃষ্ণচন্দ্রজি মন্দির।

  রাজবাড়ি কমপ্লেক্সে ঢুকে প্রথমেই দেখলাম প্রতাপেশ্বর মন্দির প্রতাপেশ্বর মন্দিরটি, রেখ- দেউল গঠন শৈলীর একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন।উনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত এই মন্দিরটির সারা গায়ে রয়েছে টেরাকোটার জমকালো কারুকার্য। মূলত বিভিন্ন পৌরাণিক আখ্যান টেরাকোটার উপর ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।মন্দিরের ভেতরে রয়েছে প্রতাপেশ্বর মহাদেবের শিবলিঙ্গ। এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে ছাদহীন রাসমঞ্চ। রাসমঞ্চের অপর পাশে রয়েছে লালজী মন্দির।সুউচ্চ এই মন্দিরটি ২৫ চূড়াবিশিষ্ট বা পঁচিশরত্ন। ১৭৩৯ সালে মন্দিরটি নির্মান করা হয়। মন্দিরটির সম্মুখভাগে রয়েছে একটি প্রকান্ড নাটমন্ডপ ও একটি পর্বতাকৃতি মন্দির যার নাম গিরিগোবর্ধন। এই মন্দিরের ভেতরে রয়েছে রাধা কৃষ্ণের একটি অপূর্ব মূর্তি। এই মন্দির থেকে বেড়িয়ে বাঁ দিকে গেলেই রয়েছে ওপর একটি পঁচিশরত্ন মন্দির যার নাম কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির।লালজী এবং কৃষ্ণচন্দ্রজী উভয় মন্দিরের গায়েই  রয়েছে নজরকাড়া টেরাকোটার কাজ। কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে ১৭৫১ থেকে ১৭৫৫ সালের মধ্যে।মহারাজা ত্রিলোকচন্দ্র বাহাদুর এই মন্দিরটি নির্মান করেন। এই মন্দিরের পেছন দিকে রয়েছে বিজয় বৈদ্য নামে অপর একটি বিশাল শিবমন্দির। এছাড়াও এই মন্দিরের উঠোনের দুইপাশে রয়েছে একটি রাম মন্দির এবং বদ্রী নারায়ণের মন্দির। ১১.৩০ নাগাদ প্রায় সমস্ত কিছু দেখার পর  এই রাম মন্দিরে আমরা বসে রইলাম। হাতে তখনও অনেকটা সময় তাই ওই মন্দিরের দাওয়াতে একটু দিবানিদ্রাও হয়ে গেল।  জায়গাটা অত্যন্ত নিড়িবিলি হওয়ার ফলে আমদের বিশ্রামে সেভাবে কোনো বাধা পড়ল না। বেলা ১.৩০ নাগাদ মন্দির থেকে বেড়িয়ে আমরা গেলাম নিকটবর্তি ভাগীরথীর ঘাটে।সেখানে স্নান করে দুপুরের খাওয়া সেরে বেলা ৩টে  নাগাদ আমরা আবার রওনা দিলাম কৃষ্ণদেবপুর হাই স্কুলের উদ্দেশ্যে।

কৃষ্ণদেবপুর হাই স্কুলে পৌঁছে দেখলাম যে ধীরে ধীরে লোক সমাগম হতে শুরু করেছে।গ্রামের লোকজন ছাড়াও কোলকাতা এবং বিদেশ থেকেও বহু লোক এই উৎসব দেখতে এসেছেন।মাঠের ভেতর তখন বিরাট একটা গর্ত খোড়ার কাজ চলছে আর তার পাশেই রাখা হয়েছে প্রকান্ড চড়কের গাছটিকে । চড়কের গাছটিকে  গ্রামের লোকজন এসে মাঝে মাঝে ফুল ও প্রনামী দিয়ে নমস্কার করে যাচ্ছেন। মাঠের আসেপাশে হরেক রকম সামগ্রীর স্টল খোলা হয়েছে। সেই সব স্টলের কোনটিতে খেলনা, কোনটিতে দৈনন্দিন প্রয়োজনের সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে এছাড়াও রয়েছে সরবত, আইসক্রিম ও ঝাল মুড়ির দোকান। ইতিমধ্যে লাল পোশাক পরিহিত একদল ছেলে মহাদেবের জয়গান করতে করতে মাঠে প্রবেশ করলো, বোঝা গেল যে এরাই চড়ক সন্ন্যাসী। এদের প্রত্যেকের হাতেই কয়েকটা করে লোহার সুতীক্ষ্ণ শিক অথবা বর্শি। আরও কিছুক্ষণ পরে শুরু হলো চড়কের আসল রীতি নীতি। একজন তান্ত্রিক গোছের লোক ও কয়েকজন জোয়ান মধ্য বয়স্ক লোক মিলে একটি বিশালাকার কালী ঠাকুরের মুখোস নিয়ে উপস্থিত হলো। মুখোসটিকে চড়কের গাছের গায়ে স্থাপন করে নানা উপাচারে পূজা শুরু হলো। পূজার শেষে অপেক্ষাকৃত অল্প বয়স্ক সন্ন্যাসীদের জিভ ও ঠোঁট লোহার শিক দিয়ে বিদ্ধ করা হলো, কারো কারো গায়ে সেফটিপিন ফুটিয়ে নানা রকম কারুকার্য করা হলো। এরপর উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি সহযোগে চড়কের গাছ টিকে পাশের গর্তটিতে বসানো হলো।সব শেষে মূল সন্ন্যাসীদের পিঠে বর্শি গেঁথে চড়ক গাছে ঝুলিয়ে ঘোরানো শুরু হলো।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়, আমরা ধীরে ধীরে কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। নাগরিক জীবনের ছোঁয়ায়ে এই  উৎসবের  জৌলুস এখন অনেকটাই ম্লান তবু এখনো এই উৎসবে রয়েছে আন্তরিকতা এবং শিকড়ের টান। দিনের শেষে মহাদেবের কাছে এটাই প্রার্থনা যে এই শিকড়ের টান যেন অটুট থাকে।  

পথের সাথী
পথের সাথী
১০৮ শিব মন্দির
১০৮ শিব মন্দির 
প্রতাপেশ্বর মন্দির
প্রতাপেশ্বর মন্দির 
লালজী মন্দির
লালজী মন্দির
লালজী বিগ্রহ
লালজী বিগ্রহ
কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির
কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির
ভাগীরথীর তিরে
ভাগীরথীর তিরে
ভাগীরথীর তিরে
ভাগীরথীর তিরে
চড়কের  গাছ
চড়কের  গাছ
চড়কের গাছে প্রাণ প্রতিষ্ঠা
চড়কের গাছে প্রাণ প্রতিষ্ঠা
শরীর বিদ্ধ করিয়া মোরা করিব পাপস্খলন
শরীর বিদ্ধ করিয়া মোরা করিব পাপস্খলন...
শরীর বিদ্ধ করিয়া মোরা করিব পাপস্খলন
শরীর বিদ্ধ করিয়া মোরা করিব পাপস্খলন...
শরীর বিদ্ধ করিয়া মোরা করিব পাপস্খলন
শরীর বিদ্ধ করিয়া মোরা করিব পাপস্খলন...

Comments

Popular Posts