প্রথম ভ্রমণ

সময়টা তখন ২০০৮, সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কলেজে ঢুকেছি। গত ৫ বছর ধরে মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের চাপে সেভাবে কথাও বেরনো হয়ে ওঠেনি। রোজকার এই রুটিন জীবনে মনটা হাপিয়ে উঠেছিল। তাই ফাস্ট সেমিস্টার পরীক্ষার পর একদিন হঠাৎ করেই ঠিক হল যে আমরা শান্তিনিকেতন আর তারাপীঠ যাব। এখানে আমরা বলতে আমি, অর্ণব, অনুরুপ, রনি আর শুভ। যেমন কথা তেমন কাজ, সেই রাতেই আমার মামা আমাদের জন্য ফোনে হোটেল বুক করে দিল। পরের দিন ৩১শে ডিসেম্বর ভোরের ট্রেনেই আমরা বেরিয়ে পড়বো বোলপুরের উদ্দেশ্যে। সেই রাতে উত্তেজনাতে ভাল ঘুম হল না। 
শান্তিনিকেতনের পথে
         
পরের দিন ভোর ৫ টা নাগাদ বেরিয়ে পরলাম আমরা। বাসে করে হাওড়া যখন পৌছালাম তখন ঘড়ি বলছে ৫.৪৫।
টিকিট কাউন্টারে তখন বেশ লাইন ওদিকে ৬.০৫ এ গণদেবতা এক্সপ্রেস ছেড়ে দেবে। কোনো মতে টিকিট কেটে আমরা দৌড় লাগালাম, ট্রেন তখন হুইসেল দিতে শুরু করেছে । ট্রেন তো কোনমতে ধরা গেল কিন্তু বিপদটা আসলো অন্য দিক থেকে। ট্রেন এ উঠে দেখলাম সব সিট ভর্তি, অগত্যা আমাদের এই তিন ঘণ্টা দাড়িয়েই যেতে হবে। অবশেষে ট্রেন চলতে শুরু করলো শুরু হল আমাদের প্রথম ভ্রমন। হাওড়া ষ্টেশন ছাড়িয়ে ট্রেন গতি বাড়াতে শুরু করলো, বাইরে তখন ঘন কুয়াশা সেভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না আর প্রবল বেগে ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্য কামরার সব দরজা জানলা বন্ধ করা। আমরা নিজেদের মধ্যে গল্প গান হাসি মজা করতে করতে চলেছি। প্রায় ৯.০০ নাগাদ আমরা এসে পৌছালাম বোলপুর। ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা কচুরি আর ডাল দিয়ে সকালের জলযোগটা সেরে নিলাম। এইবার আমাদের গন্তব্য শান্তিনিকেতন। যেহেতু আগে দুবার আমি এইখানে এসেছি তাই আমাকেই গাইডের  ভূমিকাটা নিতে হল ।
পৌষমেলাতে আমরা
          প্রথমেই আমরা গেলাম ভুবনডাঙার মাঠ অর্থাৎ পৌষমেলা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই মেলা প্রথম শুরু হয়ে ১৮৯৪ সালে। তখন অবশ্য মেলার এরকম ব্যপ্তি ছিল না। বর্তমানে এই মেলা বীরভূম তথা পশ্চিমবঙ্গের এক অন্যতম আকর্ষণ। মেলাতে স্থানীয় হস্তশিল্পের বহু স্টলের পাশাপাশি দৈনন্দিন গৃহস্থলির জিনিসও পাওয়া যায়। এছাড়াও নানারকম লোভনীয় খাওয়ারের স্টল তো আছেই। আমরাও এই বিরাট মেলা ঘুরতে ঘুরতে একটু গরম জিলিপি কিনে নিলাম। এই মেলার অপর একটি আকর্ষণ হল বাউল সঙ্গীত। এই সময় বাংলার নানা প্রান্ত থেকে বাউল সম্প্রদায়ের মানুষ এখনে আসেন এবন তাদের গানে আসর মাতিয়ে তোলেন। পৌষমেলা দেখার পর আমরা এগোলাম বিশ্বভারতীর দিকে। এইখানে বলা দরকার শান্তিনিকেতনের প্রকৃত নাম ভুবনডাঙা, ১৮৬২ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নৌকাবিহার কালে এখনে তিনি একটি ছাতিম গাছের নিচে বিশ্রাম করেছিলেন এবং প্রাকৃতিক শোভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, তিনি এখানে একটি গৃহ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন যার নাম দেন শান্তিনিকেতন। আমরা সেই ছাতিম তলা দর্শন করলাম বাঁধানো এই গাছতলার গায়ে একটি ফলকে মহর্ষির রচিত একটি কবিতা উৎকীর্ণ রয়েছে- 
                        তিনি 
                   আমার প্রাণের আরাম,
                      মনের আনন্দ,
                      আত্মার শান্তি।
পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই স্থানে নিজের বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা প্রাচীন ভারতীয় গুরুকুল ব্যবস্থা অবলম্বনে গড়ে ওঠে। এই বিদ্যালয় এখন পাঠভবন নামে পরিচিত। কবিগুরু এইখানে শিক্ষাকে চার দেওয়ালের মধ্যে বেঁধে না রেখে প্রকৃতির কোলে মুক্ত করেন কবিগুরু শুধু পাঠভবন গড়েই থেমে থাকেননি, ত্রিপুরার মহারাজার অর্থ সাহায্যে ১৯২১ সালে তিনি গড়ে তোলেন বিশ্বভারতী যা আজ সারা ভারতবর্ষের শিক্ষার এক অন্যতম পীঠস্থান। দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এইখনে পড়তে আসেন যা আক্ষরিক অর্থে এক মিলনভূমি তৈরি করেছে। বিশ্বভারতীর ভেতর আমরা একে একে দেখলাম-


দেহালি- যেখানে রবীন্দ্রনাথ মৃনালিনী দেবীর সাথে বাস করতেন।

উপাসনা গৃহ- বেলজিয়াম কাঁচের তৈরী এই গৃহ আসলে ব্রাহ্ম উপাসনা স্থল।



নতুন বাড়ি- রামকিঙ্কর বেইজ ও প্রভাস সেনের শিল্পকীর্তি সম্বলিত মাটির বাড়ী।


শান্তিনিকেতন গৃহ- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নির্মিত সব থেকে পুরনো গৃহ। হিমালয় যাত্রার প্রাক্কালে এইখনেই বালক রবি তাঁর পিতার সাথে বাস করেছিলেন।


বিচিত্রা- কবিগুরুর ব্যবহ্রত পোশাক আসবাবপত্র, বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য ছবির সংগ্রহশালা।


এছাড়াও আছে উত্তরায়ণ, কলাভবন, সঙ্গিতভবন ইত্যাদি। তাছাড়ও সমগ্র বিশ্বভারতী জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা ভাস্কর্য শিল্পের নিদর্শন। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের দেখা হয়ে গেল একজন বাউলের সাথে এতদিন পর লিখতে বসে তাঁর নাম টা আজ আর মনে নেই কিন্তু সেদিন ওনার কাছে আমরা অনেকগুলো গান শুনেছিলাম জীবনে প্রথমবার গ্রাম্য পরিবেশে এত কাছ থেকে বাউল সান্নিধ্য উপভোগ করেছিলাম সেদিন শান্তিনিকেতন দেখা শেষ, সময় বলছে বেলা ২.৩০। এইবার বিশ্বভারতীর ভেতরেই একটা ক্যান্টিনে দুপুরের ভাত খেয়ে নিলাম। খানিকক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার ষ্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। বেলা ৩.৪৫ এ ট্রেন, এইবার আমাদের গন্তব্য রামপুরহাট অর্থাৎ তারাপীঠ। ষ্টেশন পৌঁছে কিছুক্ষণ বসতে না বসতে ট্রেন এসে হাজির। চললাম তারাপীঠ। ট্রেনের জানলা দিয়ে দুই ধারের গ্রাম্য শোভা দেখতে দেখতে চলেছি। লালমাটির উপর সবুজের শোভা সত্যি মনকাড়া।


সাধক বামদেবের সমাধি মান্দির
সাধক বামদেবের সমাধি মান্দির
                             রামপুরহাট যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ঘড়িতে প্রায় ৬.৩০ টা বাজে। ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে একটু খোঁজাখুঁজির পর তারাপীঠ যাওয়ার জন্য একটা রিক্সা ভ্যান পাওয়া গেল। আমরা ৫ জন ভ্যানে উঠে বসলাম। ভ্যান ছলছে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে, দুধারে কোথাও বিরাট মাঠ নয়তো গ্রাম্য মাটির বাড়ি, চারদিকে ঝিঁ ঝিঁর শব্দ। কিছুটা যাওয়ার পর আমাদের মত আর কিছু যাত্রীর দেখা পাওয়া গেল। প্রায় ৩০মিনিট ভ্যান যাত্রার পর অবশেষে আমরা এসে পৌছালাম তারাপীঠ। ভ্যান ভাড়া মিটিয়ে আগেই আমরা হোটেল শৈলাবাস খুজে বের করলাম, এইখনেই আমদের ঘর বুক করা হয়েছিল। হোটেলে ঢুকে একটু বিশ্রাম করে নিলাম সবাই। সারাদিন অনেক ধকল গেছে সবাই খুবই ক্লান্ত কিন্তু মনে তখনও উৎসাহের শেষ নেই। বিশ্রাম নিয়ে আমরা বেরিয়ে পরলাম। রাস্তার দোকান থেকে একটু চা বিস্কুট আর তারাপীঠের বিখ্যাত লেঙচা খেলাম। ঘড়িতে তখন প্রায়ে ৮.০০ টা বেজে গেছে। গুটি গুটি পায়ে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। নাটমান্দিরে তখন শ্যামা সঙ্গীত গাইছেন কোনো এক শিল্পী। চারদিকে তখন বহু ভক্তের সমাবেশ। আমরাও মান্দিরটা একটু ঘুরে দেখলাম। এইবার আমদের গন্তব্য তারাপীঠের বিখ্যাত শ্মশান। বহু প্রাচীন রহস্য ঘেরা সিদ্ধভূমি এই শ্মশান তারাপীঠ মন্দিরের প্রাণকেন্দ্র। এই শ্মশানেই শ্বেতশিমুল বৃক্ষের নিচে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসেই সিদ্ধি লাভ করেন ঋষি বশিষ্ঠ এবং আরও পরে এই ভূমি কে পবিত্র করেন সাধক বামাখ্যাপা। দ্বারকা নদীর তীরে এই প্রাচীন শ্মশান, জঙ্গলাকীর্ণ, ভেতরে ছোট ছোট পর্ণকুটিরে তান্ত্রিক কাপালিক দের আস্তানা। শান্ত গা ছমছমে পরিবেশ। জায়গায়ে জায়গায়ে তান্ত্রিক দের যজ্ঞ পরিবেশ কে আরও ভারি করে তুলেছে। শ্মশানের ভেতরে বশিষ্ঠ দেবের সাধনক্ষেত্র এবং সাধক বামদেবের সমাধি মান্দির দর্শন করলাম। রাত প্রায় ১০.১৫ নাগাদ আমরা শ্মশান থেকে বেরোলাম। রাতের খাওয়া সেরে হোটেলে যখন ঢুকলাম তখন ঘড়ির কাটা ১১.০০ টা ছুঁই ছুঁই। রাতে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
বশিষ্ঠ দেবের সাধনক্ষেত্র
বশিষ্ঠ দেবের সাধনক্ষেত্র
                             ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন ৫.০০ টা বেজে গেছে চটজলদি স্নান করে আমি অর্নব আর শুভ তৈরি হয়ে নিলাম। পুজো দিতে যেতে হবে, বছরের শুরু টা তারা মায়ের কাছে পুজো দিয়ে শুরু করার পরিকল্পনা আর কি। পুজো দিতে যখন বেরলাম, ততক্ষণে পুজো দেওয়ার লাইন রাস্তা ছাড়িয়ে গেছে। প্রায়ে ৫ ঘণ্টা লাইন দিয়ে সেদিন আমরা পুজো দিয়েছিলাম। যদিও ভিড়ের চাপে সেদিন ঠিক করে মায়ের মুখটাও দেখা সম্ভব হয়েনি তবে জীবনে এইটা একটা অভিজ্ঞতা হয়ে রইল। পুজো দিয়ে কিছু খেয়ে আমরা হোটেল ছেড়ে দিলাম,  এইবার ফেরার পালা, ট্রেকারের ছাদে চেপে রওনা দিলাম রামপুরহাটের দিকে। পেছনে পরে রইল তারাপীঠ। ষ্টেশনে যখন পৌঁছালাম ট্রেন ছাড়তে তখনও কিছু সময় বাকি, ট্রেন পুরো ভর্তি, বসার জায়গা না পেয়ে শেষমেশ আমরা লাগেজ কম্পারটমেন্টে উঠে পরলাম। ঠিক বেলা ২.৩০ টা নাগাদ ট্রেন ছেড়ে দিল। শেষ হল আমাদের প্রথম ভ্রমণ।
তারাপীঠ মন্দির
তারাপীঠ মন্দির
নতুন বাড়ী
নতুন বাড়ী
ছাতিম তলা
ছাতিম তলা
নৃত্যরত রমণী
নৃত্যরতা রমণী
উদবাস্তু
উদবাস্তু
বাউল
বাউল
বুদ্ধ মুর্তি
বুদ্ধ মুর্তি
Pic courtesy: Avik Rakshit (Suvo)

Comments

Unknown said…
osadharonnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnnn

Popular Posts