ফিরে দেখা মাহেশ


জয় জগন্নাথ জয় জয় বলরাম।
সুভদ্রা শ্রীসুদর্শন মাহেশ শ্রীধাম।।

রথযাত্রা বললে প্রথমেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে পুরীর সুপ্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ রথযাত্রার ছবি। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে এই রথযাত্রা উৎসব পালিত হলেও পুরীর রথযাত্রাই হলো প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম। প্রাচীনতার দিক থেকে দ্বিতীয় হল হুগলি জেলার মাহেশের রথ। প্রায় ৬২০ বছরের পুরোনো এই রথযাত্রা আড়ম্বর এবং ব্যাপ্তিতে পুরীর মতো অত বড় না হলেও তা যথেষ্ট ঐতিহ্যশালী। মাহেশের এই প্রাচীন রথযাত্রার সাথে জড়িয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তি এবং মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য দেবের স্মৃতি।

২০১০ সালে, সুপ্রাচীন এই রথযাত্রা  দেখতে প্রথমবার গেছিলাম শ্রীরামপুরের মাহেশে। সেই সময় আমার সঙ্গী ছিল শুভ, গোপালদা আর গুড্ডু। সেবার সুপ্রাচীন এই রথ, মেলা, এবং অত মানুষের উদ্যম আমাদের মুগ্ধ করেছিল। আমাদের সকলের বয়স ২১ - ২২ বছরের মধ্যে হলেও গুড্ডুর বয়স তখন ছিল মাত্র ১১ বছর। কিন্তু অত ছোট বয়সেও ওর ভালোই লেগেছিল। এই বছর অর্থাৎ প্রায় ছয় বছর বাদে একরকম ওরি পীড়াপীড়িতে আবারো গেলাম মাহেশে, রথযাত্রা দর্শন করতে। ছয় বছরে রাস্তা ঘাট এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই প্রাচীন রথ ঘিরে মানুষের উচ্ছাস উদ্দীপনার বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। এখানে  পুরীর রথের মতো তিনটি আলাদা রথের ব্যবস্থা নেই। একটি সুউচ্চ রথেই জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার বিগ্রহকে চড়ানো হয়। মাহেশে যখন আমরা পৌছালাম তখন বেলা  প্রায় ২.৪৫। রথ সাজানোর কাজ চলছে পুরোদমে। রথের সামনে একদল মানুষ হরিনাম সংকীর্তন করছেন। ইতিমধ্যে জগন্নাথদেবের বিগ্রহকে  মন্দির থেকে বের করে এনে  রথে তোলার প্রক্রিয়াও শুরু হলো। বিগ্রহকে রথে তোলার একটি অদ্ভুত কায়দা রয়েছে। একটি পুরু লেপে বিগ্রহটিকে ভালো করে জড়িয়ে দড়ি দিয়ে টেনে তোলা হয়।মূর্তি তোলা হলে পর একে একে দুটি তামার ঘোড়া এবং সারথির মূর্তি এনে রথে বসানো হল।
Then - Now
তখন - এখন
     মাহেশের এই বিখ্যাত জগন্নাথ দেবের মন্দির এবং রথযাত্রার পেছনে রয়েছে এক অপূর্ব কাহিনী। সময়টা তখন চতুর্দশ শতাব্দীর আশপাশ, এই সময় ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে  এক ভক্ত সন্ন্যাসী তীর্থযাত্রায় বেড়িয়ে নানা স্থান দর্শনের পর এসে পৌঁছালেন শ্রীক্ষেত্র পুরীতে। সেখানে জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ দর্শন করে ধন্য হলেন ভক্ত ধ্রুবানন্দ। তার সাধ হলো তিনি নিজের হাতে রন্ধন করে জগন্নাথ দেবকে ভোগ নিবেদন করবেন কিন্তু পুরীর পাণ্ডাদের আপত্তিতে তার আর ভোগ নিবেদন করা হলো না। আশাহত এবং ব্যথিত ধ্রুবানন্দ তখন বসলেন আমরণ অনশনে। ভক্তের এই ব্যাকুলতায় আসন টোললো ভগবানের। ভক্ত ধ্রুবানন্দ দৈবাদেশ পেলেন যে বঙ্গদেশে ভাগীরথীর তীরে মাহেশ নামে এক স্থানে নির্দিষ্ট দিনে জলে ভেসে আসবে নিম কাঠ, তাই দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার বিগ্রহ। সেই বিগ্রহের সামনেই নিবেদন করতে হবে ভোগ। দৈবাদেশ পেয়ে ধ্রুবানন্দ আসলেন মাহেশে। সেই সময় এই অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ণ এবং শ্বাপদ সঙ্কুল। এখানেই নির্দিষ্ট দিনে ভাগীরথীর জলে ভেসে আসলো এক প্রকান্ড নিম কাঠ তাই দিয়ে প্রস্তুত হলো তিন দেবতার বিগ্রহ। ঐ স্থানেই ধ্রুবানন্দ প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের সাধন কুটির।
Mahesh Rathyatra
মাহেশের রথযাত্রা
এর পর আরও বেশ কিছু বছর বাদে চৈতন্যদেব এলেন মাহেশে এবং জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ দর্শন করে তাঁর ভাবসমাধি হল। সাধক ধ্রুবানন্দ তখন অন্তিম শয়ানে। কিন্তু বিগ্রহের সেবার ভার কার হাতে দিয়ে যাবেন সেই চিন্তায় তিনি ব্যাকুল। তাঁর কাতর অনুরোধে চৈতন্যদেব তার পার্ষদ কমলাকর পিপলাই কে বিগ্রহের সেবার ভার অর্পণ করলেন।  আজও তাঁরই বংশধরেরা এই সেবা পূজার ভার বহন করে চলেছেন।
Faith
জয় জগন্নাথ
পুরী থেকে রথযাত্রা দর্শন করে এসে কমলাকরের মনেও বাসনা জাগে মাহেশে রথযাত্রা আয়োজন করার। তাঁরই উদ্যোগে শুরু হয় এই প্রাচীন রথযাত্রা উৎসব। সেই সময় বৈদ্যবাটির এক মোদক একটি কাঠের রথ তৈরি করিয়ে দেন তাতেই শুরু হয় রথযাত্রা। এরপর প্রায় দুইশত বছর পরে শ্যামবাজারের দেওয়ান কৃষ্ণরাম বসু আরেকটি কাঠের রথ তৈরি করিয়ে দেন সেটি জীর্ণ হলে তার পুত্র গুরুচরণ অপর একটি কাঠের রথ দান করেন। ১২৬০ বঙ্গাব্দে সেটি পুড়ে যায়। মাঝে আরো দুইবার রথ পরিবর্তনের পর গুরুচরণের পৌত্র কৃষ্ণচন্দ্র বসু Martin Burn Co. থেকে একটি লোহার রথ তৈরি করিয়ে দেন। বর্তমানে এই রথটিই  ব্যবহার করা হয়।  রথটি প্রায়  ৪৫ ফুট উঁচু এবং নয় চূড়া বিশিষ্ট। দশ ফুট বেড়ের  বারোটি চাকায় রথটি চলে। রথযাত্রার দিন এই রথে চড়েই ভক্তদের ভক্তির টানে জগন্নাথ দেব, বলরাম এবং সুভদ্রা মাসির বাড়ি যাত্রা করেন। জগন্নাথ মন্দির থেকে রথ G.T. Road ধরে দেড় কিলোমিটার পথ পেড়িয়ে পাড়ি দেয় মাসির বাড়ি অর্থাৎ শ্রীরামপুরের গোপীনাথ মন্দির। রথযাত্রার দিন থেকে শুরু করে উল্টোরথের দিন পর্যন্ত জগন্নাথ দেব এখানেই সেবা পূজা গ্রহণ করেন।

রথযাত্রা দর্শন করে আমরা কিছুক্ষন মেলায় ঘোরাঘুরি করে নিকটবর্তী গঙ্গার ঘাটে গিয়ে পৌছালাম। বর্তমান গঙ্গার ঘাটটির কিছু আগে দুটি প্রাচীন শিব মন্দির ও  একটি বহু প্রাচীন ঘাট রয়েছে, পূর্বে গঙ্গার প্রবাহ এর সিঁড়ি স্পর্শ করে যেত কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গা বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে গেছে আর বট অশ্বথ গাছের ঝুড়ি বেষ্টিত এই ভগ্নপ্রায় ঘাটটি আজও নীরবে দাঁড়িয়ে সেই অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। গঙ্গাতীরে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম।ঘড়িতে তখন প্রায় ৬.১৫ বাজে। ফেরার পথে গোপীনাথ মন্দিরের কাছে তখন হাজারো মানুষের ভিড়। তিন বিগ্রহকে তখন রথ থেকে নামানোর তোড়জোড় চলছে। জগন্নাথ দেবের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে  স্টেশন অভিমুখে রওনা দিলাম।

Mahesh Rathyatra fair
মেলার মজা পাঁপড় ভাজা মেলার মজা মিষ্টি
The last boat
বেলাশেষের খেয়া
The leap of faith
উল্টো ঝাঁপ
Old ghat of Mahesh
দাঁড়িয়ে আছি একলা - যুগান্তরের পারে



Video Courtesy: Subhranil Banerjee

Comments

Popular Posts